‘গোরা’: রবীন্দ্র-চিন্তায় স্বরাজ ও জাতীয়তাবাদ
Posted on : December 12, 2021Author : Piu Karmakar
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ১২৬৮বঙ্গাব্দের ২৫শে বৈশাখ (ইংরেজি ৭-মে ১৮৬১খ্রি:)জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর ছিলেন ইউনিয়ন ব্যাংক এবং কার-ঠাকুর কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাসহ বাংলাদেশের প্রথম শিল্পোদ্যোগীদের মধ্যে একজন।তৎকালীন সময়ে হিন্দুধর্মের সংস্কারের জন্য রাজা রামমোহন রায় যে ব্রাহ্মসমাজ-এর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা রামমোহনের বিলাত যাত্রার(১৮৩০খ্রি:)পর দ্বারকানাথের অর্থসাহায্যে পরিচালিত হয়েছিল।এই ব্রাহ্মসমাজের দ্বারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অত্যন্ত প্রভাবিত ছিলেন। ১১ বছর বয়স থেকে তিনি দেশ-বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে বিভিন্ন স্থানের সংস্কৃতি, লোকাচার,দেশাচারের বিষয়গুলি আয়ত্ত করেছিলেন, যা তাঁর পরবর্তী কালের রাজনৈতিক চিন্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি ভারতবর্ষের জাতীয় সংগীত “জনগণমন” যেমন লিখেছিলেন একইসঙ্গে রচনা করেছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় সংগীত “আমার সোনার বাংলা”। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন এশিয়ার সর্বপ্রথম ব্যক্তি যিনি নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত হন। প্রকৃতির প্রতি অসামান্য ভালোবাসা তাঁকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ‘শান্তিনিকেতন’ প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। তিনি ছিলেন একজন প্রকৃত স্বদেশপ্রেমী। দেশের তথা বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলনকে তিনি নিজের লেখাপত্র ও চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত করেছিলেন। গান্ধীজিকে “মহাত্মা” উপাধিও তিনিই দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মসমাজের এক অন্যতম সদস্য। রবীন্দ্রনাথ কখনোই পাশ্চাত্যের অনুকরণে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের কথা বলেননি। তিনি মনে করতেন ইউরোপ তথা পাশ্চাত্যে জাতীয়তাবাদের মূল ভিত্তি হল রাষ্ট্র। কিন্তু আমাদের ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদের ইতিহাসে সমাজই হল প্রধান। তিনি বারংবার দেশের জনগণের আত্মনির্ভরতা ও স্বায়ত্তশাসনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি মনে করতেন যে, গঠনমূলক রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যদিয়েই ভারতীয় জনগণ নিজের চেষ্টায় এক স্বাধীন ও উন্নয়নমূলক সমাজ গড়ে তুলবে। যে কারণে তিনি লিখেছেন,“ স্বায়ত্তশাসনের অধিকার আমাদের ঘরের কাছে পড়িয়া আছে-কেহ তাহা কাড়ে নাই এবং কোনদিন কাড়িতে পারেও না। আমাদের গ্রামের, আমাদের পল্লীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পথ-ঘাটের উন্নতি, সমস্তই আমরা নিজে করিতে পারি-যদি ইচ্ছা করি, যদি এক হই। এজন্য গবর্মেন্টের চাপরাস বুকে বাঁধিবার কোন দরকার নাই। কিন্তু ইচ্ছা যে করে না, এক যে হই না। তবে চুলোয় যাক স্বায়ত্তশাসন। তবে দড়ি ও কলসির চেয়ে বন্ধু আমাদের আর কেহ নাই।”১
<script async src=”https://pagead2.googlesyndication.com/pagead/js/adsbygoogle.js?client=ca-pub-2377242298177547″
crossorigin=”anonymous”></script>
রবীন্দ্রনাথের বারোটি উপন্যাসের মধ্যে সর্ববৃহৎ,দ্বন্দ্বমূলক ও জটিল উপন্যাস হলো ‘গোরা’। তিনি তাঁর ৪৭ থেকে ৪৯ বছর বয়সে এই উপন্যাসটি লিখেছিলেন,ফলে তাঁর জীবনের এই সময়ের যে আত্মোপলব্ধি তা এখানে পরিস্ফুটিত হয়েছে।এই উপন্যাসটি প্রবাসী পত্রিকায় বাংলা,১৩১৪ ভাদ্র-১৩১৬ফাল্গুন (ইংরেজি,১৯০৭-১৯০৯খ্রিস্টাব্দ)পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছিল।এবং গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা, ১৩১৬বঙ্গাব্দে(ইংরেজি,১৯১০খ্রিস্টাব্দ)। উনিশ শতকের শেষভাগ এই উপন্যাসের প্রেক্ষাপট রচনা করেছে।এই সময়ে ভারতবর্ষ তথা বাংলায় ব্রাহ্মসমাজ ও হিন্দুসমাজের আন্দোলন,স্বদেশপ্রেম ও নারীমুক্তি আন্দোলন,জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এবং সামাজিক স্বীকৃতির আন্দোলন সংগঠিত হয়েছিল।এই সমস্ত আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে ‘গোরা’ উপন্যাসটি উঠে এসেছিল। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গ আইন প্রণয়ন করেন এবং ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে ‘সর্বভারতীয় মুসলিম লীগ’ প্রতিষ্ঠিত হয় ঢাকায়। বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির উদ্দেশ্যে রাখিবন্ধন উৎসব চালু করেন। অপরদিকে জাতীয়তাবাদী কংগ্রেসের অভ্যন্তরে শুরু হয় এক অন্তর্দ্বন্দ্ব।এই সময়ে কংগ্রেসের একদল নেতার এলিটবাদী চরিত্র জনসাধারণের থেকে কংগ্রেসকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল।এবং তাঁদের ইংরেজের প্রতি আবেদন-নিবেদনের পন্থাকে অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে গণ্য করতে শুরু করেছিলেন।যেকারণে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়,যথা-চরমপন্থী এবং নরমপন্থী। এবং একইসঙ্গে ব্রাহ্মসমাজ বনাম হিন্দুসমাজের দ্বন্দ্বের ফলে সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে এইসময় স্বদেশী আন্দোলন বনাম বিদেশি ধারার জায়গা তৈরি হয়।বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা বাংলার স্বদেশি আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ,ফলে তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে এক বৃহত্তর জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং দেশমাতৃকার প্রতি ভালোবাসার এক প্রচন্ড আবেগ লক্ষ্য করা গিয়েছিল।স্বদেশী আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রবীন্দ্রনাথ ভারতের জাতীয়তাবোধের শক্তি এবং দুর্বলতা-দুই প্রত্যক্ষ করেছিলেন।স্বদেশী আন্দোলনের ব্যর্থতাকে উন্মোচন করতে গিয়ে দেশ,জাতি ও জাতিসত্তার প্রকৃত স্বরূপ অন্বেষণে তিনি “গোরা” চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশ সম্পর্কে লিখেছিলেন যে, “আমাদের দেশকে সম্পূর্ণভাবে কেউই কেড়ে নিতে পারে না, এবং সেই দেশকে বাইরে থেকে দয়া করে কেউ আমাদের হাতে তুলে দেবে এমন শক্তি কারো নেই। দেশের পরে নিজের স্বাভাবিক অধিকারকে যে পরিমাণে আমরা ত্যাগ করেছি সেই পরিমাণে অন্যে তাকে অধিকার করেছে। পাশ্চাত্য রাজার শাসনে এইখানে ভারতবর্ষ আঘাত পেয়েছে। গ্রামে গ্রামে তার যে সামাজিক স্বরাজ পরিব্যাপ্ত ছিল রাজশাসনে তাকে অধিকার করলে।”২ গোরা উপন্যাসের সমগ্র পটভূমিকা হল তৎকালীন যখন কলকাতায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের রাজধানী প্রতিষ্ঠিত ছিল। সমাজ তখন দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল।একদিকে ছিল হিন্দুসমাজের রীতি-নীতি, মূর্তিপূজা, জাতের বিচার। এবং অন্যদিকে ছিল ব্রাহ্মসমাজ, যাঁরা হিন্দুসমাজের নেতিবাচক দিক গুলিকে খন্ডন করে ইংরেজি শাসন ব্যবস্থার ইতিবাচক দিকগুলি নিয়ে এগিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠাতা রাজা রামমোহন রায় সেই সব ক্ষেত্রে ইংরেজদের সাহায্য নিতেন যার মাধ্যমে ভারতবর্ষের মঙ্গল সাধিত হবে, কিন্তু সেই সব ক্ষেত্রে ইংরেজদের সমর্থন করতেন না যেখানে ইংরেজরা আমাদের দেশকে শোষন করতো। ফলে রাজা রামমোহন রায়ের ব্রাহ্মসমাজ এই উপন্যাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেছে।জাতিপ্রথা তৎকালীন সমাজে অত্যন্ত গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিল,যার প্রভাব বর্তমান সময়েও লক্ষ্য করা যায়।আজও আমরা জাতি-বিদ্বেষ কেন্দ্রীক চিন্তাধারার থেকে সরে এসে খুব কম ক্ষেত্রেই উন্নয়নের কথা ভাবি।আজও অনেক সমাজ ও সম্প্রদায় রয়েছে যারা জাতিপ্রথার নামে মানুষের মানবিকতাকে অস্বীকার করে।যেকারণে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘গোরা’ উপন্যাসে বিশ্বমানবতাকে গুরুত্ব দিয়ে জাতিপ্রথার উর্ধ্বে ওঠার কথা বলেছেন।তাই বর্তমান সমাজ ও রাজনীতিতে ‘গোরা’উপন্যাসটির প্রাসঙ্গিকতা ও গুরুত্ব রয়েছে
‘গোরা’ উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র “গোরা”র মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের হিন্দুত্ববাদী সংস্কার থেকে বিশ্বমানবতায় উত্তোরন দেখিয়েছেন।রবীন্দ্রনাথ কখনোই প্রত্যক্ষভাবে স্বদেশী আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেননি।তাঁর প্রতিবাদের একমাত্র মাধ্যম ছিল বিভিন্ন লেখাপত্র এবং উপন্যাস।ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ শক্তির প্রতীক হিসেবে তিনি “গোরা” চরিত্রটিকে সৃষ্টি করেছেন।প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ গোরা চরিত্রটির মধ্যদিয়ে তৎকালীন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের শিক্ষাদিতে চেয়েছিলেন যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রকৃতি কেমন হওয়া উচিত! এই উপন্যাসের এক একটি চরিত্রকে তিনি আমাদের ভারতবর্ষীয় সমাজের এক একটি দিক হিসেবে তুলে ধরেছেন। জাতীয়তাবাদ শব্দটি যে কেবলমাত্র হিন্দুত্বের আতিশয্যের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, ভারতবর্ষের প্রত্যেকটি মানুষের ঐক্যবদ্ধতাই যে জাতি গঠনের মূল উপাদান তা তিনি এই উপন্যাসের প্রত্যেকটি ঘটনা ও চরিত্র গুলির মধ্যদিয়ে বর্ণনা করেছেন। তিনি মনে করতেন যে বিদেশি শক্তির আগ্রাসী মনোভাব ভারতবর্ষের পরাধীনতার জন্য যত না দায়ী, তার চেয়ে অনেক বেশি আমাদের দেশের প্রতি নিজেদের কর্তব্য-কর্ম ও সেবার অভাব দায়ী। যে কারণে তিনি প্রকৃত স্বরাজের অর্থ উন্মোচন করতে গিয়ে লিখেছেন, “ যে দেশাত্মবোধী বলে, আগে স্বরাজ পেলে তার পরে স্বদেশের কাজ করব, তার লোভ পতাকা-ওড়ানো উর্দি-পরা স্বরাজের রং করা কাঠামোটার’ পরেই…স্বরাজ আগে আসবে, স্বদেশ সাধনা তার পরে, এমন কথাও তেমনিই সত্যহীন, এবং ভিত্তিহীন এমন স্বরাজ।”৩
এই উপন্যাসে দেখা যায় যে হিন্দু-ব্রাহ্মণ পরিবারে লালিত-পালিত হওয়ার ফলে গোরার মধ্যে হিন্দুধর্মের কুসংস্কার,গোঁড়ামি পরিপূর্ণ ছিল।সে বিশ্বাস করতো যে হিন্দুধর্মের ঐতিহ্যের উপর ভিত্তি করে এক সুন্দর,সুগঠিত ভারতবর্ষ গড়ে উঠবে। কিন্তু কলকাতা শহর ছেড়ে চড়ঘোষপুরে গিয়ে সে স্বদেশের আসল চেহারা দেখতে পায়।সেখানে ইংরেজদের অপশাসন,গ্রামের মানুষের দুর্দশা,অজ্ঞতা,কুসংস্কার দেখে সে গ্রামোন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়।সে বিনয়কে বলে,“ভারতবর্ষের সর্বাঙ্গীণ মূর্তিটা সবার কাছে তুলে ধরো-তাহলে লোকে পাগল হয়ে যাবে…প্রাণ দেবার জন্য ঠেলাঠেলি পড়ে যাবে।”৪ অর্থাৎ গ্রামের অপশাসন ও অত্যাচার মানুষের সামনে তুলে ধরলে মানুষ এগিয়ে এসে বিদ্রোহের মাধ্যমে গ্রামোন্নয়নে যোগ দেবে,যার মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন হবে।এবং তার মধ্যদিয়েই দেশকে ব্রিটিশ শৃংখল-মুক্ত করা যাবে।এখানে রবীন্দ্রনাথের জাতীয়তাবাদ ফুটে উঠেছে। তিনি বারংবারই আমাদের দেশবাসীর আত্মোন্নয়ন ও আত্মনির্ভরতার উপর জোর দিয়েছিলেন।গোরা ছিল অত্যধিক হিন্দু ব্রাহ্মণ্যধর্মের কুসংস্কারে বিশ্বাসী।প্রকৃতপক্ষে হিন্দুধর্মের আচার-আচরণ ও নিয়মের মধ্যে সে ভারতবর্ষকে গুলিয়ে ফেলেছিল।রবীন্দ্রনাথ দেখাচ্ছেন যে এটি ছিল গোরার ত্রুটি,হিন্দু ধর্মের সংস্কারের মধ্যে প্রকৃত ভারতবর্ষ নেই। জাতীয়তাবাদ বলতে তিনি কখনোই একটা জাতির বিকৃত ও বিচ্ছিন্নতাবাদী চিন্তা ভাবনাকে গুরুত্ব দেননি, এবং এই রকম বিচ্ছিন্নতাবাদী বিকৃত জাতীয়তাবাদ যে ভারতবর্ষের ঐক্যবদ্ধতাকে বিনষ্ট করবে সেই আশঙ্কা তাঁর মধ্যে নিশ্চিত রূপেই ছিল। তিনি মনে করতেন যে দেশের সকল জাতি ও সম্প্রদায়ের প্রতি সম্মান প্রদর্শন, অপরাপর সমস্ত ধর্ম ও লোকসংস্কৃতিকে গুরুত্ব দেওয়া, জনগণের মধ্যে আত্মনির্ভরতা তৈরি করা ইত্যাদি হল স্বাদেশিকতা ও জাতীয়তাবাদের মূল বিষয়। কিন্তু তিনি কখনোই বিকৃত স্বাদেশিকতা ও ভেদাভেদের জাতীয়তাবাদকে প্রশ্রয় দেননি। তাই গোরা যখন কলকাতা শহর ছেড়ে সত্তিকারের গ্রাম্য জীবনকে দেখতে বেরিয়েছে তখন সে বুঝতে পেরেছে যে নবজাগরণ বা রেনেসাঁস-এর প্রকৃত ব্যর্থতা হল-শিক্ষিতের সঙ্গে অশিক্ষিতের,গ্রাম্য জীবনের সঙ্গে শহুরে-মনস্কতার এখনো মিলন হয়নি,আমরা সেই সমস্ত অশিক্ষিত অসহায় মানুষদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারিনি।ফলে গোরার বাইরে হিন্দুত্ববাদী সংস্কারের আবরণ থাকলেও অন্তরে সেই সংস্কারের দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছে।
উপন্যাসের এক পর্যায়ে দেখা যায় যে,গোরা ব্রাহ্মসমাজকে কিছুতেই সহ্য করতে পারে না।যেকারণে তার বন্ধু বিনয়েরও ব্রাহ্ম পরেশবাবুর পরিবারে যাতায়াতকে সে ভাল চোখে নেয়নি।রবীন্দ্রনাথ দেখাচ্ছেন যে,এইখানেই রয়েছে ব্রাহ্মসমাজ বনাম হিন্দুধর্মের দ্বন্দ্ব,আধুনিক সভ্যতা বনাম প্রাচীনপন্থী সংস্কারের সংঘাত। গোরা হল জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে হিন্দুসমাজের প্রতীক।যারা মনে করত ব্রাহ্মসমাজ হল অত্যন্ত আধুনিক,যারা সমাজের কোন নিয়ম মানে না,যারা ব্রিটিশদের অনুকরণ করে এবং দেশের ঐতিহ্যকে যুক্তিদিয়ে খণ্ডন করে।
একসময়ে গোরা যখন তার আসল জন্মপরিচয় জানতে পারে যে সে আসলে এক আইরিশ দম্পতির সন্তান,তখন তার সমস্ত দ্বিধা কেটে যায়।সে পরেশবাবুকে বলে,“…আজ আমি ভারতবর্ষীয়।আমার মধ্যে হিন্দু, মুসলমান,খ্রিষ্টান কোন সমাজের কোনো বিরোধ নেই।আজ এই ভারতবর্ষের সকলের জাতই আমার জাত,সকলের অন্নই আমার অন্ন।”৫ রবীন্দ্রনাথ এখানে আসলে গোরার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী নেতাদের শিক্ষা দিলেন যে,ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ ভারতবর্ষ হিসেবে আমাদের স্বদেশী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।রবীন্দ্রনাথ নিজে হিন্দু-ব্রাহ্মণ সন্তান হয়েও ব্রাহ্মসমাজের সদস্য ছিলেন।তিনি জাতি-ধর্ম-বর্ণকে বড় না করে বিশ্বমানবধর্ম এবং মানবিকতাকে বড় করেছেন।তিনি দেখিয়েছেন যে,চড়ঘোষপুরে হিন্দুনাপিত এক মুসলিম সন্তানকে লালন-পালন করছে, তাঁর মতে এটাই আমাদের জাতীয়তাবাদের প্রকৃতি হওয়া উচিত। জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুধু ব্রাহ্মণ বা হিন্দুধর্মের আন্দোলন নয়,সমগ্র জনসমাজের আন্দোলন।
জেল থেকে ফিরে এসে গোরা যে প্রায়শ্চিত্ত ও শুদ্ধিকরণ করছে তা আসলে রবীন্দ্রনাথের ব্যাখ্যায় সমগ্র জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুদ্ধিকরণ,হিন্দুত্বের সংস্কার থেকে বিশ্বমানবতায় উত্তরণ।যখন গোরা কৃষ্ণদয়ালের কাছথেকে নিজের জন্মবৃত্তান্ত জানতে পারছে তখন তার এতদিনের হিন্দুত্ববাদী সংস্কার ভেঙে যাচ্ছে,প্রকৃতপক্ষে এখানে রবীন্দ্রনাথ দেখাচ্ছেন,যে ধর্মীয় আত্মবিশ্বাস ও সংস্কার নিয়ে আমরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন করছি তা একটা সময় তাসের মতো ভেঙে পড়বে,যেভাবে গোরার ভেঙে পড়েছে।সে আনন্দময়ীর পায়ে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে এবং বলছে,“মা,তুমিই আমার মা।যে মাকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলুম তিনিই আমার ঘরের মধ্যে এসে বসেছিলেন। তোমার জাত নেই,বিচার নেই,ঘৃণা নেই-তুমি শুধু কল্যাণের প্রতিমা।তুমিই আমার ভারতবর্ষ…।”৬ এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ভারতমাতার পায়ে আত্মসমর্পণ করছে,যে ভারতমাতা কোন জাতের বিচার করেন না। যাঁর কাছে সমাজের উচ্চবর্ণ যেমন সন্তান তেমনি পিছিয়ে পড়া নিম্নশ্রেণিও তাঁরই সন্তান।
প্রকৃতপক্ষে জাতীয়তাবাদ মানেই হলো একটি দেশের সকল মানুষের রাষ্ট্রগঠনের প্রবল ইচ্ছা,যেখানে কোন লিঙ্গ-জাতের ভেদাভেদ নেই।ভারতবর্ষের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে প্রথমদিকে এই ভেদাভেদগুলি ছিল না।এই বিভেদ কিছুটা ইংরেজ এবং কিছুটা আমাদের দেশের স্বার্থান্বেষী নেতাদের দ্বারা তৈরি হয়েছে। জাতীয়তাবাদ কখনোই একটা জাতের হয় না,যদি সেটা হয় তাহলে সেটা মারাত্মক এবং অন্যায়,সেই রকম প্রবনতার বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ ‘গোরা’ উপন্যাসটি লিখেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বারবার এখানে বলেছেন যে,অবশ্যই আমরা দেশের জাতীয়তাবাদ এবং স্বাধীনতার জন্য লড়াই করব কিন্তু সেটা যেন কখনোই বিকৃত ভেদাভেদের জাতীয়তাবাদ না হয়।গোরার উত্থান-পতনের মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদের বিবর্তন দেখিয়েছেন।তিনি বলতে চেয়েছেন যে পৃথিবীর কোন দেশই একক ভাবে বাঁচতে পারে না,তাকে অন্যের ওপর নির্ভর করতেই হয়,এটাই তার সার্থকতা।এই জাতের বিভাজন হল অলিক,যার কোন বাস্তব ভিত্তি নেই।
ব্রাহ্মণী হয়েও আনন্দময়ী কোন জাতের বিচার করেননি।তিনি আইরিশ সন্তান গোরাকে কোলে তুলে সমাজের সমস্ত নিয়ম ভঙ্গ করেছিলেন।তিনি খ্রিষ্টান দাসী লছমিয়ার হাতে জল খেতেন।অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ আনন্দময়ীর মধ্যদিয়ে দেখালেন যে এই হল আমাদের ভারতমাতা । যাঁর কাছে জাত-ধর্ম-বর্ণের ভেদাভেদ নেই,যে শুধুই মানবধর্মের ও মানবকল্যাণের প্রতীক। আনন্দময়ী আসলে ভারতমাতার স্বরুপ।যিনি বিনয়কে বলেছেন,“মানুষ বস্তুটি যে কত সত্য,আর মানুষ যা নিয়ে দলাদলি করে,ঝগড়া করে মরে তা যে কত মিথ্যে সেকথা ভগবান যেদিন গোরাকে দিয়েছেন সেই দিনই বুঝিয়ে দিয়েছেন।বাবা, ব্রাহ্মণই বা কে,আর হিন্দুই বা কে।মানুষের হৃদয়ের তো কোনো জাত নেই-সেইখানেই ভগবান সকলকে মেলান এবং নিজে এসে মেলেন।”৭এই ভারতমাতার মধ্যে কুসংস্কারের বেড়াজাল নেই।তিনি যুক্তিদিয়ে সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করেন।যেকারণে তিনি কৃষ্ণদয়ালকে বলেছিলেন,“পৃথিবীসুদ্ধ লোক আমাকে খ্রিস্টান বলে-আমি সমস্ত মেনে নিয়েই বলি;তা খ্রিস্টান কি মানুষ নয়! তোমরাই যদি এত উঁচুজাত আর ভগবানের এত আদরের তবে তিনি একবার পাঠানের,একবার মোগলের,একবার খ্রিস্টানের পায়ে এমন করে তোমাদের মাথা মুড়িয়ে দিচ্ছেন কেন?”৮ তিনি জানতেন যে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ধর্ম বলে হিন্দুত্ববাদীরা নিজেদের বড়াই করলেও আসলে মনুষত্বের ধর্মই হলো বড়।তাই “গোরা”র মধ্যদিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝেছিলেন যে, এই হলো ভারতবর্ষের মহানদিক।যেখানে জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধ্বে উঠে সেবাধর্ম বড় হয়ে উঠেছে।ফলে “জীবে দয়া করে যেই জন সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”-স্বামীজীর এই মহানুভবতা ভারতবর্ষকে মহান করে তুলেছে। সংহতি দিয়ে ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে উঠে যে নবভারত গঠনের কথা স্বামীজি বলেছিলেন তা এখানে পরিস্ফুটিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথের চিন্তায়।
প্রত্যেকটি সমাজে যেমন কেন্দ্র(Core)আছে,একইভাবে আছে প্রান্ত(Periphery)।সমাজের এই পিছিয়ে পড়া শ্রেণীও হলো ভারতমাতার সন্তান।প্রকৃতপক্ষে আনন্দময়ী হলেন রবীন্দ্রনাথের প্রতিকী চরিত্র,যার মাধ্যমে তিনি বোঝাতে চাইলেন যে বিশ্বমাতার ছবি কিরকম হতে পারে।যেকারণে গোরা পরবর্তীকালে বুঝতে পেরেছে যে,হিন্দুত্ব দিয়ে আমাদের দেশ স্বাধীন হবে না।তাই সে ভিতরের সংকীর্ণতাকে ছেড়ে ফেলে বিশ্বমাতার পায়ে আত্মসমর্পণ করছে।প্রকৃতপক্ষে হিন্দুত্বের মধ্যে এমন কিছু বিষয় আছে যা মানুষকে শৃঙ্খলিত করে রাখে।ফলে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন মানুষকে ভালোবাসা,যা আমরা ভুলে যাই।বারবার আমরা মনে করি যে আমার জাতই হলো সত্য আর বাকি সব মিথ্যে।যেকারণে সমাজে এত বিভেদ তৈরি হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়টিকে খন্ডন করতে চেয়েছেন,তিনি নিজেও হিন্দুব্রাহ্মণ পরিবারে জন্ম নিয়েছেন,সেখান থেকে ব্রাহ্মসমাজ এবং তারপর বিশ্বমানবতায় তাঁর উত্তরণ হয়েছে।আসলে গোরা হলো রবীন্দ্রনাথেরই মানস চরিত্র।
রবীন্দ্রনাথ পানুবাবু ও বড়দাসুন্দরীর মধ্যদিয়ে দেখিয়েছেন যে,তথাকথিত শিক্ষিত ব্রাহ্মসমাজের মধ্যেও নানা ধরনের ত্রুটি ও সঙ্কীর্ণতা রয়েছে,যা আমাদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করেছে।যেকারণে চরঘোষপুরে দরিদ্র প্রজাদের উপর অত্যাচারের প্রতিবাদে গোরা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কাছে অভিযোগ করলে ব্রাহ্মসমাজের প্রতিনিধি হিসেবে পানুবাবু ভারতবর্ষে ইংরেজদের শাসনকে আশীর্বাদস্বরূপ বলে মনে করেন,তিনি বলেন,“ইংরাজি বিদ্যার যেটা শ্রেষ্ঠ অংশ সেটা গ্রহণ করিবার অধিকার ইহাদের নাই।ভারতবর্ষে ইংরেজের রাজত্ব যে ঈশ্বরের বিধান এই অকৃতজ্ঞরা এখনো তাহা স্বীকার করিতে চাহিতেছে না।”৯ আবার বরদাসুন্দরী বিনয়কে হিন্দুসমাজ ত্যাগ করে ব্রাহ্মসমাজের আচার-আচরণ মেনে ললিতাকে বিবাহ করার কথা বলেছিলেন।এখানে ব্রাহ্মসমাজের একদল সদস্যদের মনের সংকীর্ণতাগুলি রবীন্দ্রনাথ পরিস্ফুটিত করেছেন।তিনি দেখালেন যে,পরবর্তীকালে ব্রাহ্মসমাজের মধ্যেও নানান সীমাবদ্ধতা ঢুকেছে।যারা পোশাকে কথাবার্তায় অত্যাধুনিক এবং সাধারণ মানুষের থেকে অনেক দূরে সরে গেছেন,যার অন্যতম প্রতীক হলো বড়দাসুন্দরী এবং পানুবাবু।রবীন্দ্রনাথ এই বিপরীত স্রোত গুলিকে অস্বীকার করেননি।তিনি দেখিয়েছেন যে মানবতাই হলো আসল ধর্ম।যেমন বাইবেলে যীশু বলছেন,“তুমি আগে প্রতিবেশীকে ভালোবাসো”অর্থাৎ প্রতিবেশীকে ভালোবাসার মধ্যদিয়ে তুমি ধীরে ধীরে উত্তরিত হও বিশ্বমানবতায়।
বিনয় হিন্দুসমাজের অন্তর্ভুক্ত হলেও তার মধ্যে গোরার মতো কোনো সংস্কার বা অন্ধ-গোঁড়ামি ছিল না।সে সকলধর্ম ও সমাজকেই সাদরে গ্রহণ করত,যে কারণে সে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য পরেশবাবুর বাড়িতে যাতায়াত করতো।সে ছিল উদার মনের মানুষ, তাই সে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীদের অংশগ্রহণকে গুরুত্ব দেয়।আসলে রবীন্দ্রনাথ নিজেও নারী জাগরনের কথা স্বদেশী আন্দোলনে বারবার বলেছেন।বিনয়ের মধ্যেদিয়ে রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়েছেন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে এই ভাবেই উদারমনস্কতা, শিক্ষা ও নম্রতা নিয়ে আমাদের ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে,যেখানে কোনো সংকীর্ণতা থাকবে না।যে কারণে তিনি বিনয় চরিত্রটির মাধ্যমে উল্লেখ করেছেন,“আমরা দেশকে বলি মাতৃভূমি,কিন্তু দেশের সেই নারীমূর্তির মহিমা দেশের স্ত্রীলোকের মধ্যে যদি প্রত্যক্ষ না করি…তাহলে কখনোই দেশের উপলদ্ধি আমাদের কাছে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে না।”১০
সুচরিতা হল ব্রাহ্মসমাজের সদস্যা,আসলে সে হলো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নারীবাদী কণ্ঠস্বর।যে যুক্তি ও শিক্ষা দিয়ে সমস্ত কিছুকে গ্রহণ করে।যেকারণে সে ভারতবর্ষকে মহান বলে জেনেছে,তার কাছে ভারতবর্ষ হলো এক বিরাট ভক্তিস্থান।যেখানে দেশের সেবাকে সে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনেকরেছে।তাই সে নিজের ভাইকে শিক্ষাদিয়ে বলেছে,“একটা খুব বড়দেশে তুই জন্মেছিস…সমস্ত হৃদয় দিয়ে এই বড়দেশকে ভক্তি করবি,আর সমস্ত জীবন দিয়ে এই বড়দেশের কাজ করবি।”১১ আসলে রবীন্দ্রনাথ সুচরিতা চরিত্রটির মধ্যদিয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সংস্কারমুক্ত আধুনিক নারীসমাজকে ব্যক্ত করেছেন এবং নারী অধিকারের কথা বলেছেন।রবীন্দ্রনাথ জানতেন যে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গেলে আমাদের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধশক্তি হিসেবে লড়াই করতে হবে,যেখানে লিঙ্গ ও জাতির ভেদাভেদ থাকবে না।
পরেশবাবু নিজে ব্রাহ্মসমাজের সদস্য হয়েও সকল ধর্ম ও জাতিকে শ্রদ্ধা করতেন।প্রকৃতপক্ষে রবীন্দ্রনাথ পরেশবাবুর মধ্যদিয়ে ব্রাহ্মসমাজের ইতিবাচক দিকগুলো তুলে ধরেছেন,যেখানে আধুনিকতা থাকলেও সকলের প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধা রয়েছে। ভারতবর্ষের অগ্রগতিতে এমন মুক্ত ও উচ্চমানের আধুনিকপন্থী মানুষের প্রয়োজন যাঁরা জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতাদের সঠিক পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন বলে রবীন্দ্রনাথ মনে করেছেন।যেকারণে তিনি গোরার মধ্যদিয়ে উল্লেখ করেছেন,“আপনার কাছেই এই মুক্তির মন্ত্র আছে-আমাকে আপনার শিষ্য করুন।আপনি আমাকে আজ সেই দেবতারই মন্ত্র দিন যিনি হিন্দু মুসলমান খ্রিস্টান ব্রাহ্ম সকলেরই-যার মন্দিরের দ্বার কোন জাতির কাছে কোন ব্যক্তির কাছে কোনদিন অবরুদ্ধ হয় না।যিনি কেবল হিন্দুর দেবতা নন-যিনি ভারতবর্ষের দেবতা।”১২
রবীন্দ্রনাথ নেশন এবং ন্যাশনালিজমের ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন, “জাতিমিশ্রণ হয় নাই য়ুরোপে এমন দেশ নাই। ইংলাণ্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি কোথাও বিশুদ্ধ জাতি খুঁজিয়া পাওয়া যায় না, এ কথা সকলেই জানেন। রাষ্ট্রনীতিতন্ত্রে জাতিবিশুদ্ধির কোনো খোঁজ রাখে না…নেশন ধর্ম মতের ঐক্যও মানেনা ব্যক্তিবিশেষ ক্যাথলিক,প্রটেস্টান্ট,ইহুদি অথবা নাস্তিক যাহাই হোক না কেন তাহার ইংরেজ, ফরাসি ,জার্মান হইবার কোন বাধা নাই।”১৩ অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের মতে নেশন গঠনের ক্ষেত্রে কোনো জাত বা ধর্মের বিভাজন নেই।যেকোন ধর্মের মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে নেশন গঠন করতে পারেন। আমাদের যে দেশীয়-সংস্কৃতি,লোক-সংস্কৃতি সেখানেও বিশ্বমানবতার কথা বলা হয়েছে।রবীন্দ্রনাথ বুঝতে পেরেছিলেন যে আমাদের লৌকিক ধর্মকে বাদ দিয়ে ভারতবর্ষের সংস্কৃতি গড়ে উঠতে পারে না।ভারতবর্ষের মত এক বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশে অপরাপর সমস্ত জাতি,ধর্ম এবং সম্প্রদায়গুলিকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই হলো এক স্বাস্থ্যকর গণতন্ত্রের লক্ষণ।যেকারণে ‘গোরা’উপন্যাসটি বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে পুনর্বার পড়া ও ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন রয়েছে।
তথ্যসূত্র
১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,”সফলতার সদুপায় “,আত্মশক্তি, জন্মশতবার্ষিক সংস্করণ ( কলিকাতা:
পশ্চিমবঙ্গ সরকার, বাংলা১৩৬৮), ১২ খন্ড, পৃ. ৭১৮।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর , “রবীন্দ্রনাথের রাষ্ট্রনৈতিক মত” , কালান্তর ,(কলকাতা: বিশ্বভারতী ,
১৯৯০) পৃ. ৬৬৪।
৩. প্রাগুক্ত, পৃ. ৬৭০।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, “গোরা”,রবীন্দ্রউপন্যাস সমগ্র (অখণ্ড), (কলকাতা: বিশ্বভারতী, ১৯৯০) , পৃ. ১৮।
৫. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৪।
৬. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৫।
৭. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৮০।
৮. প্রাগুক্ত, পৃ. ২৫।
৯. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৪০।
১০. প্রাগুক্ত, পৃ. ১৩০।
১১. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা. ৩৩৬।
১২. প্রাগুক্ত, পৃ. ৩৭৪।
১৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর,“নেশন কি”,আত্মশক্তি, (কলকাতা:বিশ্বভারতী ,১৯৯০), পৃ. ৬২০।
১৪. অমর্ত্য মুখোপাধ্যায়, “রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর:ভারত ভাবনা” , সত্যব্রত চক্রবর্তী (সম্পাদিত) , ভারতবর্ষ রাষ্ট্রভাবনা ,তৃতীয় সংস্করণ, (কলকাতা:প্রকাশন একুশে,২০১৪) , পৃ. ১১২-১১৬।
১৫. Lecture on Nationalism, Title: “Democracy now: The Scorecard on Modi Sarkar” by-Pratap Bhanu Mehta, At India Today Conclave, 2019, [Accessed on:3rd October,2021], YouTube link: https://youtu.be/9BA4266SYeA
Piu Karmakar
Intern, Asia in Global Affairs
Well written by Piu. Thanks to her for understanding Tagore and articulating in reader friendly way. However, I want to share a few points. I think if nationalism is synonymous with humanism, then a mindset is developed that let our society be developed first and foremost, freedom in political sense could be achieved later. I mean to say that within the discourse of nationalism we construct a mutually exclusive relationship between political campaign and society and we sacrifice the later to go whole hog for freedom. In other words, the relations is as complex as antithesis between freedom and social equality, hence difficult to reconcile by simple intervention in the domain of rural reconstruction. Even if it is possible to reach out to local space and people, it is difficult to apply to everywhere because the nature of village community is not same and to treat them as lacking power is not a correct strategy because unity and improvements cannot be brought about by outside, but through inner awareness and our local communities are endowed with ample sense of community.
Whatever without lingering I once again convey my greetings to Piu and AGA.